Published at: Bonik Barata, March 24, 2019
ব্যক্তির আয়ের একটি অংশ ভোগের পর যা থাকে তা-ই তার সঞ্চয়। ব্যক্তিগত এ সঞ্চয় জাতীয় সঞ্চয়েরও উৎস। জাতীয় সঞ্চয়ের আরো দুটি উৎস আছে—সরকারি সঞ্চয় ও বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঞ্চয়। তবে সামগ্রিক সঞ্চয় বেশি নির্ভর করে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের ওপর। আর এ সঞ্চয়ে মূল ভূমিকায় যারা, সেই সম্পদশালীদের অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রবাসীদের পাঠানো আয়ও সঞ্চয়ে ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে উচ্চপ্রবৃদ্ধিতেও উজ্জীবিত নয় জাতীয় সঞ্চয়। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত ভোগও।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় দুই-ই বাড়ছে দেশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছর শেষে তা ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছবে বলে প্রাক্কলন করেছে সংস্থাটি। আর গত অর্থবছরের ১ হাজার ৭৫১ ডলারের মাথাপিছু আয় চলতি অর্থবছর শেষে দাঁড়াবে ১ হাজার ৯০৯ ডলারে।
উচ্চপ্রবৃদ্ধি ও মাথপিছু আয় সত্ত্বেও জাতীয় সঞ্চয়ের হারে এর প্রতিফলন নেই। বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশের জাতীয় সঞ্চয় ছিল জিডিপির ৩০ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয় জিডিপির ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ থাকলেও গত অর্থবছরে তা নেমে আসে ২৭ দশমিক ৪২ শতাংশে। গত এক দশকে জাতীয় সঞ্চয়ের হার এর চেয়ে কম আর হয়নি।
এর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয় ছিল জিডিপির ২৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। পরের অর্থবছর এটি বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা আরো বেড়ে হয় ৩০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয়ের হার পরের বছরই কমে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ২৩ শতাংশে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এটি আরো কমে ২৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে নেমে আসে।
যদিও ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে জাতীয় সঞ্চয়ের হার ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করেছে বিবিএস। কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন আছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে আমানত সংকট চলছে। আশাব্যঞ্জক অবস্থায় নেই পুঁজিবাজার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঞ্চয়ও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, সাধারণভাবে জাতীয় আয় বাড়লে সঞ্চয় বাড়ার কথা। সঞ্চয়ের যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, সেটি আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দেশে বিনিয়োগের চিত্র থেকেও এটি স্পষ্ট। কারণ বিনিয়োগের বড় অংশই সঞ্চয় থেকে। আর বাকিটা দেশী-বিদেশী ঋণ ও চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত থেকে।
দেশে সঞ্চয়ের বড় উৎস প্রবাসীদের পাঠানো আয়। এ আয়ও সঞ্চয়ে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠায়, তার ৩৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ ব্যয় হয় পরিবারের লোকদের খাওয়া-পরায়। শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয়ে ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং আসবাব ও অন্য সামগ্রী ক্রয়ে ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগে যাচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ৪৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে আর্থিক খাতে সঞ্চয় স্কিম ও বীমা পলিসিতে যাচ্ছে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ।
এ ভোগের সঙ্গে জাতীয় সঞ্চয়ের হ্রাস-বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। ভোগ ব্যয় বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই সঞ্চয় কমে যায়। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই ব্যক্তি ভোগও নিম্নমুখী। বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, এক দশক আগেও যেখানে জিডিপিতে ভোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের অবদান ছিল ৭৪ শতাংশের বেশি। পরবর্তী সময়ে তা নিম্নগামী হয়েছে। সর্বশেষ সমাপ্ত অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে ভোগের হার ছিল ৭০ দশমিক ৮১ শতাংশ। চলতি অর্থবছর শেষে তা ৬৯ দশমিক ৭৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে প্রাক্কলন করেছে বিবিএস। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ভোগে ব্যক্তি খাতের অবদান ছিল জিডিপির ৬৮ দশমিক ৬৭, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৯ দশমিক ১৩, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭২ দশমিক ৪৪, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭২ দশমিক ৫৭, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭২ দশমিক ৮৫, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭৩ দশমিক ৭৪ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ৭৪ দশমিক ২১ শতাংশ।
ব্যক্তি ভোগের হার নিম্নমুখী হওয়ার পরও জাতীয় সঞ্চয় উজ্জীবিত না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, জাতীয় সঞ্চয়ের এ গতিতে অনেকটাই প্রভাব ফেলতে পারে আমাদের জনমিতিক অবস্থা। জনগোষ্ঠীতে এ সময়ে প্রান্তিক আয়ের মানুষ যুক্ত হওয়ার হার এর একটা কারণ হতে পারে। এছাড়া সঞ্চয়ের প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাবেও বিমুখ হয়ে উঠতে পারে মানুষ। পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সঞ্চয়ের মাধ্যমে মুনাফার সুযোগ আগের তুলনায় কমে আসারও একটা প্রভাব থাকতে পারে এক্ষেত্রে।
সঞ্চয় কমায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতেও। গত ১০ বছরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবৃদ্ধির হার। ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ২০১০ সালে ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকিং খাতে আমানত কমছে। সাধারণ মানুষের হাতে সঞ্চয়ের মতো উদ্বৃত্ত অর্থ না থাকা ব্যাংকিং খাতে আমানত কমার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের মধ্যবিত্ত সমাজই ব্যাংক আমানতের বৃহৎ উৎস বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার সঙ্গে দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এসেছে। আগে মানুষ আয় থেকে সামান্য অংশ হলেও সঞ্চয়ের চেষ্টা করত। কিন্তু এখন ভালোভাবে বেঁচে থাকাকেই মধ্যবিত্ত সমাজ বেশি গুরুত্ব দেয়। এ কারণে মানুষের সঞ্চয় কমতে পারে।
তিনি বলেন, মধ্যবিত্তদের সঞ্চয়ই হলো দেশের ব্যাংকিং খাতের আমানতের বৃহৎ উৎস। সম্পদশালীরা ব্যাংকে টাকা না রেখে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করে। নিজের মূলধনের সঙ্গে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তা হয়। কিন্তু ব্যাংক আমানতের সুদহার কম হওয়ায় মধ্যবিত্তরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সুদহারের তুলনায় আমানতের সুদহার প্রায় অর্ধেক। এজন্য মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য ভিড় করছে। ব্যাংকে আমানতের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জিডিপির এ প্রবৃদ্ধির কারণ হিসেবে অর্থমন্ত্রী জানান, জিডিপি হিসাবের জন্য ১৫টি কম্পোনেন্টের মধ্যে প্রায় সবই ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। বিশেষ করে রফতানি খাত, বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতে প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল। প্রবৃদ্ধিতে যে গতি অর্জন হচ্ছে, তাতে ২০২০ সালের পরের তিন বছরে ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন করা অসম্ভব নয়।
তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কোনো একক সংখ্যা নয়, মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরো অনেক সূচক। প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সঞ্চয় কমে যাওয়ার বিষয়টি সংগতিপূর্ণ নয়। অর্থনীতির কোন সমস্যার কারণে এটি হচ্ছে, তা চিহ্নিত করতে হবে।