Published at: Bonik Barta, March 25, 2019
খেলাপি ঋণ কম দেখাতে প্রতিনিয়ত পুনঃতফসিলের পথে হাঁটছে ব্যাংকগুলো। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃহৎ খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন। এ কারণে কম দেখাচ্ছে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার। তবে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণ যোগ করে যে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ (স্ট্রেসড অ্যাডভান্সেস), তার হার দাঁড়ায় খেলাপি ঋণের দ্বিগুণেরও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গত ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, একই সময়ে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ছিল ১৯ শতাংশ।
বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণের কিস্তি টানা তিন মাস পরিশোধ না করলে ওই ঋণকে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ছয় মাস পরিশোধ না করলে সন্দেহজনক ও নয় মাস কিস্তি বকেয়া পড়লে সে ঋণকে মন্দমানের খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হয়। শ্রেণীকৃত এ ঋণই খেলাপি হিসেবে বিবেচিত। কোনো গ্রাহক খেলাপি হওয়ার পর ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারেন না। গ্রাহককে সুবিধা দিতেই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এছাড়া ২০১৫ সালে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এমন গ্রুপগুলোকে তা পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত এ ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৮ সালে রেকর্ড ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। একই বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে বিদায়ী বছরে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ যোগ করলে ২০১৮ সাল শেষেও দেশের ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ২২ শতাংশের বেশি দাঁড়ায়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যালান্সশিট পরিচ্ছন্ন দেখাতে ব্যাংকগুলো বাছবিচার ছাড়াই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করছে। আইন অনুযায়ী কোনো ঋণ তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলের সুযোগ না থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রভাবশালী গ্রাহকরা ১০ বারেরও বেশি পুনঃতফসিল সুবিধাও নিয়েছেন। তার পরও সে ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় পুনর্গঠন করা ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের চেয়ে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণের হার বেড়ে গেছে।
স্ট্রেসড ঋণের হার খেলাপি ঋণের দ্বিগুণ হওয়াকে অ্যালার্মিং হিসেবে দেখছেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আরফান আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাংক ও ব্যবসায়ী উভয় পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভুল-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোনো দরকার। এক্ষেত্রে ব্যাংকও কিছু ছাড় দিক, ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে আসুক। নিয়ন্ত্রক সংস্থা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখুক। তাহলে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হবে। অন্যথায় বিপদ আরো বাড়বে।
আইএমএফের তথ্য বলছে, ২০১৩ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ওই বছর শেষে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনকৃত ঋণ ছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে ২০১৩ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতির ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। এর পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকলেও দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
ব্যাংকিং খাতে স্ট্রেসড ঋণের বিদ্যমান হারকে উদ্বেগজনক বলছেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণকে স্ট্রেসড ঋণ হিসেবে দেখাই। ব্যাংকিং খাতে স্ট্রেসড ঋণের বিদ্যমান হার অবশ্যই উদ্বেগজনক।
খেলাপি গ্রাহকদের ক্যাশ-ফ্লো দেখে ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা হলে সেটি খেলাপি হয় না জানিয়ে এ ব্যাংকার বলেন, ঢাকা ব্যাংকের অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে সুখকর। আমাদের পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণ খুব বেশি খেলাপি হয়নি। উচ্চ আদালতের রিটের কারণে অনেক ঋণ খেলাপি দেখানো যাচ্ছে না। সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে স্ট্রেসড ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ১ লাখ ৭ হাজার ২৬০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে রেকর্ড ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে গত বছর। এর আগে ২০১৭ সালে ১৯ হাজার ১২০ কোটি, ২০১৬ সালে ১৫ হাজার ৪২০ কোটি, ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ১৪০ কোটি, ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৩৫০ কোটি ও ২০১৩ সালে ১৮ হাজার ২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল। এছাড়া ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় পুনর্গঠন করা হয়েছিল ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিসংখ্যান কিংবা ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিটে দেখানো চিত্রই দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা নয় বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো নিজেদের অবস্থা ভালো দেখাতে অনেক তথ্যই গোপন করছে। অনেক ঋণ বহু আগেই খেলাপি হওয়ার উপযুক্ত হলেও তা খেলাপি দেখানো হচ্ছে না। শাখা ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে শীর্ষ নির্বাহী সবাই নিজেদের দক্ষ ও সফল দেখানোর চেষ্টা করছেন। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে যুক্তদের ঋণ খেলাপি হলেও কৌশলে তা গোপন রাখা হচ্ছে। নিজেদের সফল দেখাতে অনেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আয় নয়, এমন অর্থও আয়ের খাতে দেখাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ ও মধ্যম সারির বেশ কয়েকজন ব্যাংকার এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় পরিচালিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষায়ও এমন চিত্র উঠে এসেছে। সাধারণত ১৫ মার্চের ১৫ মধ্যেই আগের বছরের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে ব্যাংকগুলো। কিন্তু এবার মার্চ শেষ হতে চললেও বেশির ভাগ ব্যাংকই আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি। অনেক ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের হিসাবে বড় ত্রুটি ধরা পড়ছে। খেলাপি হওয়ার উপযুক্ত হলেও খেলাপি দেখানো হয়নি এমন ঋণও উদ্ঘাটিত হচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাযথ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয়নি, ইতিপূর্বে বাড়তি মুনাফা দেখানোসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা দলের কাছে ধরা পড়েছে।
আদায় না বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ কমানো যাবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে হলে আদায় বাড়াতে হবে। পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণ যাতে খেলাপি না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মন্দ গ্রাহককে ঋণ না দিয়ে ভালো গ্রাহকে ঋণ দিলে তবেই দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার কমে আসবে। স্ট্রেসড ঋণের পরিমাণ ও হার কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিয়েছে।